ইউরোপের দেশগুলোর নাগরিকত্ব পাওয়া আজকাল অনেকের জন্য একটি আকর্ষণীয় লক্ষ্য। বিভিন্ন কারণেই মানুষ ইউরোপের নাগরিকত্ব পেতে চায়, যেমন: উন্নত জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তা। তবে ইউরোপের দেশগুলোর নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রক্রিয়া প্রতিটি দেশে ভিন্ন। কিছু দেশ নাগরিকত্ব প্রদানে সহজলভ্য প্রক্রিয়া রাখে, যেখানে কিছু দেশে এটি অনেক বেশি কঠিন।
এই পোস্টে আপনি যা যা জানতে পারবেন:
ইউরোপের যে সকল দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ
১. পর্তুগাল
পর্তুগাল ইউরোপের অন্যতম সহজ দেশ নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য। পর্তুগাল সরকার বিদেশিদের জন্য একটি সহজ ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়া চালু করেছে। সাধারণত, পর্তুগালের নাগরিকত্ব পেতে হলে কমপক্ষে পাঁচ বছর দেশটিতে বসবাস করতে হয়। পর্তুগালে বসবাসের ভিসা পেতে ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রোগ্রামটি বেশ জনপ্রিয়। বিনিয়োগের মাধ্যমে (যেমন: রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ) এই ভিসা প্রোগ্রামের অধীনে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজতর।
২. মাল্টা
মাল্টা একটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, যা ইউরোপের অন্যতম প্রিয় দেশ হয়ে উঠেছে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য। মাল্টার নাগরিকত্ব পাওয়া দ্রুত এবং সহজ হতে পারে যদি কেউ ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে আবেদন করে। এই প্রোগ্রামের আওতায় প্রার্থীদের মাল্টার অর্থনীতিতে সরাসরি বিনিয়োগ করতে হয়। সাধারণত মাল্টায় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ১-৩ বছরের মধ্যে প্রক্রিয়া শেষ হয়।
৩. স্পেন
স্পেন নাগরিকত্ব পেতে অপেক্ষাকৃত সহজ দেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য প্রায় দশ বছর দেশটিতে বাস করতে হয়। তবে স্পেনে একটি ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রোগ্রামও চালু আছে যা আপনাকে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেয়। স্পেনের নাগরিকত্ব পেতে হলে ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং কিছু সংস্কৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রমাণ দেখানো প্রয়োজন হয়।
৪. আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ড তার লিবারেল অভিবাসন নীতিমালার জন্য পরিচিত। নাগরিকত্ব পেতে হলে আপনাকে আয়ারল্যান্ডে পাঁচ বছর বসবাস করতে হবে। এছাড়া আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটিই প্রধান শর্ত: আপনি আয়ারল্যান্ডে নির্দিষ্ট সময় বসবাস করছেন এবং দেশের আইন অনুসরণ করছেন।
৫. গ্রিস
গ্রিসের নাগরিকত্ব পেতে হলে ন্যূনতম সাত বছর বসবাস করতে হবে। তবে গ্রিসে নাগরিকত্ব পাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো ‘গোল্ডেন ভিসা’। এই ভিসার মাধ্যমে আপনি রিয়েল এস্টেটে নির্দিষ্ট বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় বসবাসের অনুমতি পাবেন।
৬. সাইপ্রাস
সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব পাওয়া কিছুটা দ্রুত এবং সহজ হতে পারে যদি আপনি অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হন। দেশটি নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য একটি বিনিয়োগ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেখানে বড় বিনিয়োগ করলে আপনি দ্রুত নাগরিকত্ব পেতে পারেন। তবে সাইপ্রাসের প্রোগ্রামগুলো সাধারণত উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা থাকে।
৭. ইতালি
ইতালির নাগরিকত্ব পেতে হলে আপনাকে কমপক্ষে দশ বছর বসবাস করতে হবে। তবে ইতালির নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রক্রিয়া অনেক সহজ এবং অনেকগুলো দেশে থাকাকালীন ইতালিতে আবেদন করা যায়। ইতালিতে জন্মগতভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুবিধাও রয়েছে।
উপরোক্ত দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য কিছু ইউরোপীয় দেশেও নাগরিকত্ব অর্জন তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে। তবে এটি নির্ভর করে আবেদনকারীর ব্যক্তিগত পরিস্থিতি, দক্ষতা ও যোগ্যতার উপর।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- নাগরিকত্ব আবেদনের আগে প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট আইন ও প্রবিধান সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।
- কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য সাধারণত সেই দেশের ভাষায় দক্ষতা, দেশটিতে বসবাসের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পূরণ, আইন মেনে চলা এবং অন্যান্য যোগ্যতা মানদণ্ড পূরণ করতে হয়।
- প্রতিটি দেশের নাগরিকত্ব আবেদন প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সময়সীমা ভিন্ন হতে পারে।
আরো জানুন: বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের কোন কোন দেশে যাওয়া যায়
ইউরোপীয় দেশগুলোতে নাগরিকত্ব লাভের প্রধান উপায়গুলো
নাগরিকত্ব লাভের সাধারণত কয়েকটি প্রধান উপায় রয়েছে। এই উপায়গুলো ভিন্ন ভিন্ন দেশের নীতিমালা অনুযায়ী কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়গুলো নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত:
১. জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Birth)
- জুস সোলি (Jus Soli): কিছু দেশে, যদি কোনো ব্যক্তি সেই দেশে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে দেশের নাগরিকত্ব পায়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়।
- জুস সাংগুইনিস (Jus Sanguinis): এই পদ্ধতিতে যদি একজনের বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের নাগরিকত্ব থাকে, তবে সেই ব্যক্তিও নাগরিকত্ব পেতে পারে। বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
২. প্রাকৃতিকীকরণ (Naturalization)
- প্রাকৃতিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে সেই দেশে নির্দিষ্ট সময় ধরে বসবাস করতে হয়। এই সময়সীমা দেশভেদে পরিবর্তিত হতে পারে (৫ থেকে ১০ বছর সাধারণত প্রয়োজন হয়)।
- প্রাকৃতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় সাধারণত দেশের ভাষা জানার পরীক্ষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান, এবং কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড না থাকার শর্ত থাকে।
৩. বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizenship by Investment)
- কিছু দেশ অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থীরা সেই দেশে নির্দিষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করলে দ্রুত নাগরিকত্ব পেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, মাল্টা, সাইপ্রাস, এবং পর্তুগালে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
৪. বিবাহের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizenship by Marriage)
- অনেক দেশে, যদি কোনো ব্যক্তি সেই দেশের নাগরিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এটি সাধারণত দ্রুত নাগরিকত্ব পাওয়ার একটি উপায় হতে পারে, তবে শর্ত হিসেবে দেশটিতে কিছু সময় বসবাস করতে হয়।
৫. আশ্রয় বা শরণার্থীর মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizenship by Asylum or Refugee Status)
- অনেক দেশ আশ্রয়প্রার্থী বা শরণার্থী হিসেবে গ্রহণকৃত ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট সময় পর নাগরিকত্ব প্রদান করে। যেসব ব্যক্তি যুদ্ধে বা নিপীড়নের কারণে অন্য দেশে আশ্রয় নেন, তারা প্রায়শই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব পান।
৬. বিশেষ অবদানের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizenship by Special Merit)
- কিছু দেশে অসাধারণ দক্ষতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, খেলাধুলা, বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখলে দ্রুত নাগরিকত্ব পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অলিম্পিক অ্যাথলেট বা নোবেল বিজয়ীদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় নাগরিকত্ব প্রদান করা হতে পারে।
৭. বংশগত নাগরিকত্ব (Citizenship by Descent)
- কিছু দেশে আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে আপনার পূর্বপুরুষ সেই দেশের নাগরিক ছিলেন, তাহলে আপনিও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন। এটি অনেক দেশে সহজলভ্য এবং কম জটিল একটি প্রক্রিয়া।
৮. সংগ্রামী প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব (Citizenship by Statutory Process)
- কিছু দেশে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এটি সাধারণত বিশেষ অবস্থায় প্রযোজ্য, যেমন: বিভিন্ন চুক্তির অধীনে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া।
এই উপায়গুলো নির্দিষ্ট দেশ ও তার নীতিমালার উপর নির্ভর করে কার্যকর হয়।
আরো জানুন: ইউরোপের সেনজেন ভুক্ত দেশের তালিকা
উপসংহার
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পর্তুগাল, মাল্টা, এবং স্পেনসহ আরও কয়েকটি দেশে তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব। নাগরিকত্ব প্রাপ্তির শর্তাবলী দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে, তাই আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা জরুরি।
তবে সাধারণত বিনিয়োগ প্রোগ্রামের মাধ্যমে অনেক দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকে। তাই যদি আপনি অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত হন, এই প্রোগ্রামগুলো আপনার জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে।