পরিযায়ী পাখির নামের তালিকা: একটি বিস্তারিত আলোচনা

পরিযায়ী পাখিরা প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার, যারা হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায়। তারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এবং প্রজনন, খাদ্য সংগ্রহ, এবং উষ্ণতার জন্য ভ্রমণ করে। পরিযায়ী পাখিরা শুধুমাত্র পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না, বরং তাদের জীবনচক্রের মাধ্যমে আমাদের প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।

পরিযায়ী পাখি কেন পরিভ্রমণ করে?

  • খাদ্যের সন্ধান: শীতকালে যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন অনেক পাখি উষ্ণ অঞ্চলে চলে যায়।
  • প্রজনন: কিছু পাখি নির্দিষ্ট জায়গায় বাসা বানিয়ে বাচ্চা দেয়। প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশের সন্ধানে তারা দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করে।
  • আবহাওয়া: অনুকূল আবহাওয়ার সন্ধানে পাখিরা পরিভ্রমণ করে।

পরিযায়ী পাখির নামের তালিকা:

১. বার-হেডেড গুজ (Bar-headed Goose)

এই পাখিটি হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়তে সক্ষম এবং পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে অন্যতম। শীতকালে তারা তিব্বত এবং মঙ্গোলিয়া থেকে ভারতের সমতলভূমিতে আসে।

২. আমুর ফ্যালকন (Amur Falcon)

আমুর ফ্যালকনরা পূর্ব এশিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত দীর্ঘ ভ্রমণ করে। তাদের এই ভ্রমণ প্রায় ২২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

৩. অল্ড ওয়ার্ল্ড স্প্যারো (Old World Sparrow)

এই পাখিটি ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পরিযান করে।

৪. বার্নাকল গুজ (Barnacle Goose)

উত্তর ইউরোপের আর্টিক অঞ্চল থেকে বার্নাকল গুজরা শীতকালে পশ্চিম ইউরোপের তীরবর্তী অঞ্চলে চলে আসে। এদের শীতকালীন পরিযান অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।

৫. কুরু (Common Crane)

কুরু পাখি বিশ্বের বৃহত্তম পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে অন্যতম। তারা ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার মধ্যে ভ্রমণ করে এবং তাদের মহাকাব্যিক পরিযান প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে বিস্ময় জাগিয়েছে।

৬. সাইবেরিয়ান ক্রেন (Siberian Crane)

এই পাখি সাইবেরিয়ার শীতল অঞ্চল থেকে প্রতি বছর ভারতে আসে। শীতকালে তারা কেবলমাত্র ভারতের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া যায়।

৭. ওরিয়েন্টাল প্রেটিনকোল (Oriental Pratincole)

এই পাখিটি এশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পরিযান করে। তাদের যাত্রা প্রতি বছর দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর।

৮. আর্কটিক টার্ন (Arctic Tern)

আর্কটিক টার্ন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘদূর পরিযায়ী পাখি। এরা আর্কটিক অঞ্চল থেকে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত ভ্রমণ করে, যা প্রায় ৭০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

৯. কুজনা পাখি (Northern Pintail)

এই পাখি উত্তর গোলার্ধের অনেক দেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার দিকে পরিযান করে। তাদের পরিযান তাদের প্রজনন এবং খাদ্যের চাহিদা পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১০. রেড-নেকড ফ্যালারোপ (Red-necked Phalarope)

এই ছোট আকারের পাখিটি আর্কটিক অঞ্চলে প্রজনন করে এবং শীতকালে দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে।

বাংলাদেশে দেখা যায় এমন কিছু পরিযায়ী পাখি:

  • শীতকালীন পরিযায়ী: সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা, কুলাউ ইত্যাদি।
  • গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী: হাঁস জাতীয় কিছু পাখি।

পরিযায়ী পাখি বছরের কোন সময় দেখা যায়:

পরিযায়ী পাখি বছরের কোন সময় দেখা যায়, তা নির্ভর করে পাখির প্রজাতির উপর। সাধারণত দুই ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়:

  • শীতকালীন পরিযায়ী: এই পাখিগুলো সাধারণত শীতের শুরুতে বাংলাদেশে আসে এবং বসন্তের শুরুতে চলে যায়। উত্তর এশিয়া, সাইবেরিয়া ইত্যাদি ঠান্ডা অঞ্চল থেকে খাবারের সন্ধানে এরা বাংলাদেশে আসে।
  • গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী: এই পাখিগুলো সাধারণত গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে আসে এবং শরৎকালে চলে যায়। এরা সাধারণত হাঁস জাতীয় পাখি হয়।

কোন কোন মাসে দেখা যায়?

  • জুলাই-আগস্ট: কিছু শীতকালীন পরিযায়ী পাখি এই সময় থেকেই বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।
  • সেপ্টেম্বর-নভেম্বর: এই সময় বেশিরভাগ শীতকালীন পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে।
  • নভেম্বর-জানুয়ারি: এই সময় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।
  • ফেব্রুয়ারি-মার্চ: এই সময় থেকে শীতকালীন পরিযায়ী পাখিগুলো ধীরে ধীরে তাদের আগমনস্থলের দিকে ফিরে যায়।

কোথায় দেখা যায়?

পরিযায়ী পাখিগুলো সাধারণত জলাশয়, হাওর, খাল, বিল, বন, বাগান ইত্যাদি স্থানে দেখা যায়।

কিছু উদাহরণ:

  • শীতকালীন পরিযায়ী: সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা, কুলাউ ইত্যাদি।
  • গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী: হাঁস জাতীয় কিছু পাখি।

পরিযায়ী পাখি দেখার জন্য কোথায় যাবেন?

বাংলাদেশে অনেক জায়গায় পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • কুয়াকাটা: সমুদ্র সৈকত এবং কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।
  • সুন্দরবন: বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এখানেও বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।
  • হাওর অঞ্চল: সিলেট, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলের হাওরগুলোতে শীতকালে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে।

পরিযায়ী পাখিদের গুরুত্ব:

  • পরিবেশগত ভারসাম্য: পরিযায়ী পাখি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • জীববৈচিত্র্য: এরা জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
  • পর্যটন: পরিযায়ী পাখি দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক বাংলাদেশে আসেন।

পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণ:

  • আবাসস্থল সংরক্ষণ: পাখিদের আবাসস্থল সংরক্ষণ করা জরুরি।
  • শিকার বন্ধ: পাখি শিকার বন্ধ করা উচিত।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষের মধ্যে পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

আরো পড়ুন: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ১০টি উপায়

উপসংহার

পরিযায়ী পাখি প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের সংরক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব। আশা করি, এই নিবন্ধটি পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।

Leave a Comment